ডিজিটাল বাদ্যযন্ত্রের দাপটে কমেছে হারমোনিয়ামের কদর, হারিয়ে যেতে বসেছে হারমোনিয়াম তৈরি শিল্প।



সুমন পাত্র,ঝাড়গ্ৰাম(খবর7দিন প্লাস): ঝাড়গ্রামে হারমোনিয়াম তৈরি শিল্প লুপ্ত হওয়ার মুখে। সংরক্ষণের দাবি শিল্পীদের। জেলার বিভিন্ন এলাকায় আগে হারমোনিয়াম তৈরি হতো। কিন্তু ডিজিটাল বাদ্যযন্ত্রের দাপটে হারমোনিয়ামের কদর কমেছে। স্থানীয় কারিগররা পেশা বদলে  অন্য কাজ বেছে নিচ্ছেন। তবে বিনপুর-১ ব্লকের আঁধারিয়ায় এখনও হারমোনিয়াম তৈরি হয়। আঁধারিয়ার অরুণাভ মাসান্ত পারিবারিক পেশা আগলে হারমোনিয়াম তৈরি করে চলেছেন। দোকান থেকে ভেসে আসে হারানো দিনের সুর।

বর্তমানে সঙ্গীতের সহযোগী বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়াম, তবলা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। ইলেকট্রিক গিটার, কি বোর্ড, ড্রাম সেট সঙ্গীতের জগতে পাকা জায়গা করে নিয়েছে। একদশক আগেও শহর, মফস্বল থেকে গ্ৰামগঞ্জের সাংস্কৃতি উৎসব অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম তবলা শোভা পেত। স্কুল, কলেজ, পাড়ার জলসায় হারমোনিয়াম ছাড়া চলত না। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শিখত। তাই প্রায় প্রতিটি বাড়িতে হারমোনিয়াম থাকত। মান্না দে থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়রা সারা জীবন হারমোনিয়াম বাজিয়েই গান গাইতেন। সময় বদলে যাওয়ার আক্ষেপ এখন কারিগরদের গলায়। হারমোনিয়াম চাহিদা কমতে থাকায় ঝাড়গ্রামের দক্ষ কারিগররা কাজ হারাচ্ছেন। তবে আঁধারিয়ার বাজার এলাকায় ছোট দোকান ঘরে হারমোনিয়াম তৈরি এখনও হয়ে চলেছে। অরুণাভবাবুর বাবা পেশায় শিক্ষক নিমাইচাঁদ মাসান্ত প্রায় নব্বই বছর আগে আঁধারিয়ার বাজারে দোকান খুলেছিলেন। নিজের হাতে হারমোনিয়াম তৈরি করতেন। তৈরি করেছিলেন একাধিক দক্ষ কারিগর। পুরনো দিনের সেই দোকান আজও টিকে রয়েছে। দোকান ঘরে ঢুকলেই দেখা যায় সেগুন গাছের কাঠের পাটা ছড়ানো ছিটানো। ঘরজুড়ে কাঠপালিশের গন্ধ। সার সার করে সাজানো ছেনি ও হাতুড়ি। সেই সময়ে কলকাতা শহর থেকে হারমোনিয়ামের জার্মান রিড আনা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই রিড আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ইতালিয়ান রিড আনা শুরু হয়। ষাটের দশক পর্যন্ত সেই সরবরাহ চালু ছিল। বর্তমানে গুজরাতের সৌরাষ্ট্র থেকে কলকাতা হয়ে হারমোনিয়ামের রিড আসে। যার জন্য খরচও বেশি পড়ে। অরুণাভ মাসান্ত বলেন, বাবাকে হারমোনিয়াম তৈরির নেশা পেয়ে বসেছিল।  হারমোনিয়ামের সুর নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। তাঁর তৈরি হারমোনিয়ামের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাবার কাছেই আমরা দুই ভাইয়ের হারমোনিয়াম তৈরি করা শেখা। ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর হারমোনিয়াম তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিই। হারমোনিয়াম তৈরির জন্য মূলত সেগুন কাঠ লাগে। এছাড়াও পাইন ও ওক কাঠের প্রয়োজন হয়। টু সেট বক্স হারমোনিয়ামের দাম ১৪ হাজার টাকা। থ্রি সেটের দাম ১৮ হাজার টাকা পড়ে। একটা হারমোনিয়াম তৈরি করতে প্রায় একমাস সময় লেগে যায়। রিডগুলো গুজরাতের সুরাত থেকে কলকাতার ডিলারদের কাছে আসে। সেখান থেকে আমরা নিয়ে আসি। জেলায় আমরা এখনও হারমোনিয়াম তৈরি করি। এই শিল্প লুপ্ত হওয়ার মুখে। কারিগরের দক্ষতার উপর নির্ভর করে হারমোনিয়ামের আওয়াজের মিষ্টত্ব। নতুন প্রজন্ম অবশ্য এই শিল্প সম্বন্ধে আগ্ৰহ হারাচ্ছে। বিনপুরের সিংপুরের বাসিন্দা বছর তিরিশের অর্জুন পাত্র বলেন, হারমোনিয়াম কীভাবে তৈরি হয় তা নিয়ে আগ্ৰহ তৈরি হয়েছিল। অরুণাভবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে উনি কাজ শেখাতে রাজি হন। কিন্তু এখন নতুন করে হারমোনিয়াম তৈরির দক্ষ কারিগর তৈরি না হলে অচিরেই এই শিল্প হারিয়ে যাবে।

নবীনতর পূর্বতন