বিশেষ প্রতিবেদন,(খবর7দিন প্লাস):- দুর্গাপুজোর পর বাঙালির অন্যতম মহোৎসব হলো শ্যামা পুজো। বারোয়ারি থেকে পারিবারিক—প্রতিটি পুজোতেই থাকে ভক্তির আবহ, তবে পূর্ব বর্ধমান জেলার বুদবুদের মানকর গ্রামের ভট্টাচার্য বাড়ির “বড়কালীর পুজো” যেন এক অন্য জগতের অধ্যায়।
এই পুজো ৭০০ বছরে পদার্পণ করেছে এবারে, আর সেইসঙ্গে নবীন প্রজন্মকেও মনে করিয়ে দিচ্ছে ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও অলৌকিকতার মেলবন্ধন।
রামানন্দ গোস্বামীর তপস্যা থেকেই শুরু বড়কালীর পূজা এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাধক রামানন্দ গোস্বামী। প্রায় সাতশো বছর আগে তিনি বুদবুদের মারো গ্রাম থেকে এসে মানকরের শ্মশানে তপস্যা শুরু করেন।
পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন কৃষ্ণভক্ত, কিন্তু রামানন্দ গোস্বামী ছিলেন দেবী কালীর ভক্ত। সাধনালব্ধ সিদ্ধির পর দেবীকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন “প্রাণাহুতি”। কিন্তু তিনি কাউকে বলি না দিয়ে নিজেই জীবন্ত অবস্থায় সমাধি গ্রহণ করেন।
তার সমাধির ওপরই গড়ে ওঠে বর্তমান বড়কালীতলা মন্দির, যেখানে আজও পুজো হয় তাঁর নির্দেশিত নিয়মে। সেই সময় থেকেই ভট্টাচার্য পরিবার এই পুজোর দায়িত্ব পালন করছে।
দেবীর অলৌকিক শক্তি—প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রচলিত কাহিনি
ভট্টাচার্য পরিবারের প্রবীণ সদস্য মুক্তিপদ ভট্টাচার্য জানান, দেবীর মূর্তির চক্ষুদান কখনও সন্ধ্যার পর করা হয় না।
একবার এক শিল্পী ভুলবশত সন্ধ্যার পর চক্ষুদান করেছিলেন, এবং পরের দিন রহস্যজনক দুর্ঘটনায় আহত হন। স্বপ্নে দেবী তাঁকে দর্শন দিয়ে সতর্ক করেন। সেই থেকেই এই নিষেধ আজও কঠোরভাবে মানা হয়।
আরেক অলৌকিক ঘটনার কথা প্রচলিত আছে—একবার পুজোর সময়ে পুরোহিত তালশাঁস খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অসময়ে তালশাঁস কোথায় পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সকলেই চিন্তিত। তখন এক ভক্ত স্বপ্নাদেশ পান, পাশের পাড়ার একটি তালগাছে দেবী স্বয়ং ফল ধরিয়েছেন। গিয়ে দেখা যায়—অলৌকিকভাবে এক গাছে সত্যিই তালশাঁস ধরে আছে!
“কালো মহিলার শাঁখা কেনা”—আজও প্রচলিত অলৌকিক কাহিনি
আরও একটি অদ্ভুত গল্প প্রচলিত আছে বড়কালীর পুজোকে ঘিরে। কয়েক শতাব্দী আগে এক শাঁখারি গ্রামে শাঁখা বিক্রি করতে আসেন। তখন এক কালো রঙের, দীর্ঘকেশী মহিলা এসে চারগাছা শাঁখা কিনে টাকা দেওয়ার বদলে বলেন “ভট্টাচার্য পাড়ার বড়কালীতলায় গিয়ে বাণীকণ্ঠ ভট্টাচার্যকে বলো, কোলঙ্গা থেকে টাকা নিয়ে নিও।”
ভট্টাচার্যের কোনো কন্যা না থাকলেও মন্দিরের কোলঙ্গা থেকে সত্যিই টাকা পাওয়া যায়! সন্দেহে পুকুরপাড়ে গেলে দেখা যায় পুকুর থেকে শাঁখাপরা চারটি কালো হাত উঠে আসে!
আজও সেই শাঁখারি পরিবারের বংশধরেরা পুজোর সময় মন্দিরে শাঁখা দান করেন।
ভোগ ও বলির অনন্য রীতি
এই পুজোয় ভোগের বিশেষত্বও অন্য রকম এখানে দেবীকে দেওয়া হয় আধ সিদ্ধ পাঁঠার মাংস ও কারণ (মদ)।ভোগে আরও থাকে পাঁচ রকম ভাজা, পাঁচমিশালী ডাল, শাক, বড়িপোস্ত, দাঁত খোঁচানোর কাঠি, এবং চ্যাং মাছ পোড়া।
পাঁঠা বলির রীতিও প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। মন্দিরের পাশে বলির মাংস রান্না হয়, যা পরে খিচুড়ির সঙ্গে গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। পুজোর দিনে কয়েক হাজার মানুষ এই ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করেন
বিসর্জনের প্রাচীন রীতি আজও অপরিবর্তিত
দেবীর বিসর্জনেও রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য। এখানে কোনো শোভাযাত্রা হয় না। বরং মাচা বানিয়ে দেবীকে কাঁধে তুলে গ্রাম প্রদক্ষিণ করানো হয়, তারপর গ্রামের প্রান্তের পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়।প্রতিষ্ঠার সময় যেমন নিয়ম ছিল, আজও ঠিক তেমনই অবিকল নিয়মে চলে এই পূজা।
আজও জাগ্রত দেবী
মানকরের মানুষ বিশ্বাস করেন—দেবী বড়কালী জাগ্রত। কেউ মানসিক করলে তিনি খালি হাতে ফিরে যান না।দেবীর আশীর্বাদে ভট্টাচার্য পরিবারের সকলেই প্রতিষ্ঠিত এবং সুখে আছেন।
প্রতি বছর শ্যামা পুজোর রাতে মানকর গ্রাম জেগে থাকে দেবী দর্শনে, ভোগে, মন্ত্রোচ্চারণে এবং অলৌকিক বিশ্বাসে।

