রঙে-রেখায় ইতিহাসের ক্যানভাস: লবণধার পূর্ব বর্ধমানের ‘আল্পনা গ্রাম’


নিউজ ডেস্ক, পূর্ব বর্ধমান(খবর7দিন প্লাস):-ছবির গ্রাম—শুনতে যেন কল্পকাহিনি। কিন্তু বাস্তবেই এমন একটি গ্রাম রয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলায়। বুদবুদ থানার অন্তর্গত আউশগ্রাম ব্লকের দেবশালা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অবস্থিত প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রাম লবণধার, যা আজ দেশে-বিদেশে পরিচিতি পেয়েছে ‘আল্পনা গ্রাম’ বা ‘ছবির গ্রাম’ নামে।

লবণধার যেন এক চলমান ক্যানভাস। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দেওয়াল, অলিগলি আর পথঘাট জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে শিল্পীদের রঙিন তুলির ছোঁয়া। কোথাও আলপনার সূক্ষ্ম নকশা, কোথাও লোকশিল্পের চিরচেনা রূপ, আবার কোথাও আধুনিক ভাবনার সঙ্গে লোকসংস্কৃতির মেলবন্ধন। সব মিলিয়ে গোটা গ্রামটাই যেন এক জীবন্ত শিল্পগ্যালারি।

শুধু দেওয়ালের শিল্পই নয়, প্রকৃতিও এই গ্রামের বাড়তি আকর্ষণ। আউশগ্রাম জঙ্গলমহলের বুক চিরে থাকা এই গ্রামে শীতের মরশুমে দেখা মেলে ময়ূরের ঝাঁক, নানান প্রজাতির পাখি। ভাগ্য ভালো থাকলে ময়াল সাপ বা নেকড়ে বাঘেরও দেখা মেলে বলে জানান স্থানীয়রা। ফলে শীতের আবহে লবণধার হয়ে উঠেছে পর্যটকদের নতুন গন্তব্য।

শিল্পের শিকড়ে লুকিয়ে লোকজ ইতিহাস

লবণধারের দেওয়ালে আঁকা ছবিগুলি শুধু সৌন্দর্যের বাহার নয়, সেগুলি কথা বলে—আদিবাসী জীবনের গল্প, প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান আর প্রজন্মান্তরের লোকসংস্কৃতির ইতিহাস। যুগ যুগ ধরে এই গ্রামের আদিবাসী মেয়ে-বউরা উৎসব-পার্বণ কিংবা দৈনন্দিন জীবনে নিজেদের ঘরের দেওয়ালে ছবি এঁকে সাজাতেন। সেই লোকশিল্পই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লবণধারকে দিয়েছে আলাদা পরিচয়।সম্প্রতি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে বোলপুর থেকে পেশাদার শিল্পীরা এসে গ্রামের দেওয়ালে দেওয়ালে নতুন শিল্পকর্ম এঁকেছেন। লোকশিল্পের সঙ্গে আধুনিক ভাবনার মেলবন্ধনে তৈরি এই ছবিগুলি গ্রামটিকে এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা ও নতুন পরিচিতি।

তিনশো বছরের ইতিহাস, বদলে যাওয়া নাম

লবণধারের জন্মকথাও কম আকর্ষণীয় নয়। ইতিহাসের পাতা উল্টালে প্রায় তিনশো বছর পিছিয়ে যেতে হয়।


আউশগ্রামের দেবশালার ঘন জঙ্গলের মধ্যে ‘বড়ডোবা’র তীরে একটি বিশাল বটগাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল আদিবাসী পাড়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জনপদ নানা পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে।

সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের উত্তাল সময়ে আউশগ্রামের বেনাচাপড়া এলাকায় অশান্তির আবহ তৈরি হলে আতঙ্কে সেখানকার কিছু মানুষ আশ্রয় নেন বড়ডোবার পাশে। গড়ে ওঠে নতুন বসতি—নাম রাখা হয় ‘নতুনগ্রাম’। তবে সেই নাম স্থায়ী হয়নি। লোকমুখে গ্রামটি পরিচিতি পায় ‘লবণধার’ নামে। আজ সেই লবণধারই পরিচিত ‘ছবির গ্রাম’ বা ‘আল্পনা গ্রাম’ হিসেবে।

গ্রামের বাসিন্দা অর্চনা রায়, গোপীজীবন মেটেরা সহ অনেকেরই আশা—এই শিল্পই হোক তাঁদের গ্রামের মূল পরিচয়। ইতিমধ্যেই আশপাশের এলাকা তো বটেই, দূরদূরান্ত থেকেও পর্যটকেরা ভিড় জমাচ্ছেন লবণধারে।

তাঁদের বিশ্বাস, খুব শিগগিরই একডাকেই সবাই চিনবে আউশগ্রামের এই গ্রামকে
রঙে, রেখায় আর ইতিহাসে গড়া এক অনন্য ‘আল্পনা গ্রাম’ হিসেবে।

নবীনতর পূর্বতন